সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

বিতর্ক, যুক্তি এবং আবেগ

বিতর্ক, যুক্তি এবং আবেগ
-------------------------------------------------------------
তর্ক করব না; তাই বিতর্ক করব।  তর্ক থেকে বিতর্ক একেবারেই আলাদা ৷ তর্কে যুক্তি থাকে না, বিতর্কে থাকতেই হয় ৷ থাকতে হয় ভাষার চমৎকার ব্যবহার ও যথার্থ আবেগও ৷ মানুষ হিসেবে আমাদের সবার মধ্যেই আবেগ থাকে ৷ দুঃখ, বেদনা, আনন্দ, সাফল্য, ব্যর্থতা সবই থাকে ৷ আর এমনটাই স্বাভাবিক ৷ তবে বিতর্ক যেহেতু বিশেষভাবে তর্ক, তাই এতে যুক্তির প্রাধান্যই বেশি ৷ বিতার্কিকের একটি যুক্তিনির্ভর মন থাকতে হবে ৷ যুক্তির চর্চা করতে হবে ৷ তার জন্যে প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে ৷ কারণ যদি বিষয়গুলো পরিষ্কার জানা না থাকে, তাহলে যুক্তির বিনির্মাণ করা যায় না ৷ ফলে যে কোনো বিষয়েই বিস্তারিত পড়াশোনা খুবই জরুরি। তবে কেবল পড়লেই চলবে না, মনের ভেতরে সেগুলোকে জায়গাও করে দিতে হবে I দরকারের সময় ঠিক বক্তব্য ঠিক জায়গায় উপস্থাপনের পারদর্শিতা অর্জন করতে হবে।  যুক্তির মধ্যে বুদ্ধি ও জ্ঞানের ছাপ থাকতে হবে।  বিতর্ক আমাদের পড়াশোনার প্রতি আগ্রহী করে, কৌতূহলী করে।  আর এ কারণেও বিতর্ক করব ৷
আগেই বলেছি বিতর্কে যুক্তিই সব নয়।  বিতর্কে আবেগ থাকে, থাকতে হয়।  থাকতে হয় ভালো চিন্তার একটি মন ৷ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রমাণই সব; এখানে আবেগের কোনো স্থান নেই।  তার প্রমাণ করতে গিয়ে ভাষার ব্যবহারে যদি যথার্থ আবেগ আনা যায় তবে সেই বক্তব্য হবে হৃদয়গ্রাহী ৷
প্রখ্যাত বিতার্কিক বিরূপাক্ষ পাল তাঁর ‘বিতর্কে আবেগ: হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ‘বিতর্ক যদি একটি শিল্প হয় কি'ৎবা শৈলী হয়, তাহলে এ কথাও মনে রাখতে হবে পৃথিবীর কোনো শিল্প বা শৈলীই আবেগবর্জিত নয়।  পৃথিবীর এমন কোনো বড় বিতর্ক সৃষ্টি হয়নি যা আবেগবর্জিত, এমন কোনো বিখ্যাত ভাষণ সৃষ্টি হয়নি যার সাথে আবেগের সার্থক মিথক্রিয়া সম্পন্ন হয়নি, এমন কোনো উদ্বুদ্ধকরণ ঘটেনি যার গভীরতম আসনে আবেগ উদ্দীপকের ভূমিকায় অধিষ্ঠিত ছিল না।
সভ্যতার আদিলগ্ন থেকেই আবেগ মানুষের চিরবন্ধু, চিরনির্ভর। ফলে বোঝাই যাচ্ছে বিতর্কে আবেগের জায়গা ভালোভাবেই আছে ৷ তবে তা কোনো অবস্থাতেই যুক্তিকে বাদ দিয়ে নয় ৷ যুক্তি বিতর্কের প্রাণ ৷ আর আবেগ হচ্ছে বিতর্কের অলংকার, যার সার্থক ব্যবহার বিতর্কের সৌন্দর্য বাড়ার ৷ এর সাথে থাকতে হয় ভাষার যথার্থ ব্যবহার ৷ বিতার্কিকের ব্যক্তিত্বের ওপর নির্ভর করে তার বক্তব্য মানুষ কতটা বিশ্বাসযোগ্য হিসেবে গ্রহণ করেছে ৷ বিতর্কে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনও বড় বিষয় ৷
বিরূপাক্ষ পালের লেখা থেকেই বিতর্কে আবেগ যুক্ত করার একটি উদাহরণ তুলে ধরছি। ' এই মুহূর্তে বিদেশী সাহায্য বন্ধ করে দেয়া উচিত' বিষয়ের বিপক্ষের বক্তাও দক্ষতার সাথে আবেগের ব্যবহার করতে পারেন নিম্নোক্ত ধরনের ভাষণেঃ
'সম্মানিত সভাপতি, প্ৰতিপক্ষের বক্তা বিদেশী সাহায্য এই মুহূর্তে বন্ধ করে দিয়ে তার গভীর দেশগ্রেমের পরিচয় দিতে চাইলেন।  কিন্তু তা গভীর দেশপ্রেম নয়; এটা অন্ধ দেশপ্রেম ৷ ' এটা আত্মঘাতী দেশপ্রেম ৷ তিনি কাব্যিক আবেগের আশ্রয়ে রবীন্দ্রনাথকে টেনে এসেছেন।  
তিনি বলেছেন ‘মায়ের দেয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই দীন দুঃখিনী মা যে তোদের তার যে বেশি সাধ্য নাই। ’
কিন্তু যেখানে মোটা কাপড়ই নেই, সেখানে কী মাথায় তুলে নেব? আগে মোটা কাপড় উৎপাদনের ব্যবস্থা তো করতে হবে। তার জা…ন্য আপাতত বিদেশী সাহায্যে কাপড়ের কারখানা গড়ে তুলতে হবে, দেশের মোট বস্তের চাহিদা মেটাবার মতো আত্মশক্তি অর্জন করতে হবে এবং তখন বিদেশী সাহায্য বর্জন করতে হবে।  প্রতিপক্ষ রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ পড়েছেন, পড়েননি রবীন্দ্রনাথের আত্মশক্তি কবিতা, যেখানে তিনি বিপদ অতিক্রমের জন্য আগে আত্মশক্তি অর্জনের কথা বলেছেন। ’
উপরের উদাহরণটি থেকে বিতর্কে আবেগের ব্যবহার বোঝা গেল।  কেবল আবেগ নয়, একই উদাহরণে যুক্তি দিয়ে প্রতিপক্ষের বক্তব্য খণ্ডনের চেষ্টাও আছে।  ফলে যুক্তি আর আবেগের মিশেলে এগিয়ে যাওয়া বক্তব্যই বিতর্ক। 
তাহলে কেন বিতর্ক করব? এই প্রশ্নের উত্তর আরো নানাভাবেই ভাবা যায় ৷ যেমন জনপ্রিয় লেখক আনিসুল হক তাঁর এক লেখায় উল্লেখ করেছেন, ‘মনে রাখতে হবে একটা চিন্তার বিপরীতে অন্য চিন্তা থাকতে পারে।  একটা দৃশ্যের পেছনে আরেকটা দৃশ্য থাকতে পারে।  এই বিষয়গুলো ‘বিতর্ক’ আমাদের শেখায় ৷’

চমৎকার উপস্থাপনা, বাচনভঙ্গি ও শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলতে পারার যোগ্যতা বিতার্কিকের থাকতেই হয়।  তবে এগুলেড়া কারো থাকে কম, কারো বেশি ৷ চেষ্টা আর চর্চা অব্যাহত রাখলে এসবের অনেক কিছুই অর্জিত হতে পারে। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Thank you for your comment.

AI in Education, AI in Teaching: Revolutionizing Learning

Artificial Intelligence (AI) is changing many fields. Education and teaching are no exceptions. ...